বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নতুন করে ডানপন্থি ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গঠনের আলোচনা জোরালো হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি দলের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন চলছে চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরির কাজ।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও রাজনীতির নতুন মেরুকরণ
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং জামায়াত পৃথকভাবে জোট গঠনের প্রস্তুতি নেয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দুই দলের মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ৩০টি রাজনৈতিক দলের ১৩তম দিনের বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে নারী আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন ছিল আলোচনার প্রধান বিষয়।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌখিক ঐক্য থাকলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট মতভেদ রয়েছে। সরাসরি নির্বাচন না মনোনয়ন ভিত্তিক হবে — এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
সংবিধান সংশোধন ও নারীর অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে প্রস্তাব
কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হবে — যেসব রাজনৈতিক দল ২৫টি বা তার বেশি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, তাদের মধ্যে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থী রাখতে হবে।
তবে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে সিপিবি, বাসদসহ কয়েকটি দল সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে।
দ্বিকক্ষ সংসদ গঠনে উচ্চকক্ষ নিয়ে মতবিরোধ
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪টি জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশনকে ভিত্তি করে উচ্চকক্ষ (সিনেট) গঠিত হবে এবং এসব এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন।
কিন্তু অনেক দলের মতে, এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন জটিল এবং স্থানীয় সরকার কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের মতামত
সালাহউদ্দিন আহমেদ (বিএনপি): নারী আসন ১০০তে উন্নীত করার বিষয়ে একমত হলেও সরাসরি নির্বাচন বর্তমান বাস্তবতায় কঠিন। তিনটি সাধারণ আসন একত্র করে একটি নারী আসন নির্বাচন করার প্রস্তাব অবাস্তব।
ডা. তাহের (জামায়াত): উচ্চকক্ষ ও নারী আসনের জন্য আমরা সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব (PR পদ্ধতি) ব্যবস্থার পক্ষে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স (সিপিবি): সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্তির প্রস্তাবের বিরোধী। আমরা চাই সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হোক।
জোনায়েদ সাকি (গণসংহতি আন্দোলন): নারীদের ৩৩ শতাংশ আসনে মনোনয়ন বাস্তবায়ন এখনই সম্ভব নয়। সংরক্ষিত আসন ও সরাসরি ভোট উভয়ই রাখা প্রয়োজন।
শাহাদাৎ হোসেন সেলিম (এলডিপি): নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি, তবে পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী (জমিয়ত): নারীরা এখন অনেকটাই সক্ষম। তাদের নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাওয়া উচিত, সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন নেই।
বজলুর রশিদ ফিরোজ (বাসদ): নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরাসরি নির্বাচনের বিকল্প নেই।
শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন (জেএসডি): সরাসরি ভোট ছাড়া নারীর সঠিক প্রতিনিধিত্ব সম্ভব নয়। ৩টি সাধারণ আসনের আওতায় ১টি নারী আসনে ভোট হতে পারে।
সারসংক্ষেপ
আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন নতুন মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে নারী প্রতিনিধিত্ব ও দ্বিকক্ষ সংসদ গঠন নিয়ে চলছে মতবিনিময় ও বিতর্ক। এই সব আলোচনার ফলাফল দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।